বাহাই ধর্ম: কোথায়, কিভাবে এর উৎপত্তি
বাহাই
ধর্ম: কোথায়, কিভাবে এর উৎপত্তি
বাহাই
ধর্ম একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম
যা উনিশ শতকে পারস্যে
(বর্তমান ইরান) উদ্ভূত হয়েছিল। এটি বিশ্বের অন্যতম
নবীন ধর্ম এবং এর
অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বাহাই ধর্ম জাতি, বর্ণ,
লিঙ্গ, বা ধর্মের ভিত্তিতে
কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই মানবজাতির আধ্যাত্মিক ঐক্য এবং ঐক্যের
ওপর জোর দেয়। এই
ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর
যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্ম
প্রচারকের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে নিজেকে প্রকাশ
করেছেন। বাহাউল্লাহ, যিনি বাহাই ধর্মের
প্রতিষ্ঠাতা, তাঁদের মতে তিনি হলেন
এই যুগের সর্বশেষ নবী।
এই নিবন্ধে, আমরা বাহাই ধর্মের
ইতিহাস, এর মূল বিশ্বাস,
ধর্মীয় আচার, এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক
বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
বাহাই
ধর্মের ইতিহাস
বাহাই
ধর্মের সূত্রপাত হয় ১৮৪৪ সালে,
যখন "বাব" (ফার্সিতে "দ্বার" বা "প্রবেশপথ") নিজেকে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে প্রেরিত
একজন নতুন বার্তাবাহক হিসেবে
ঘোষণা করেন। তাঁর অনুসারীরা বাবকে
বাহাউল্লাহর আগমন এবং একটি
নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখেন। বাবের শিক্ষার মূল বিষয় ছিল
আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সংস্কারের
আহ্বান এবং ঈশ্বরের আগত
দূত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা।
১৮৫০
সালে বাবের মৃত্যুদণ্ডের পর, মির্জা হুসেন
আলী নুরি, যিনি পরবর্তীতে বাহাউল্লাহ
নামে পরিচিত হন, তিনি এই
ধর্মের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৬৩ সালে বাহাউল্লাহ
নিজেকে সেই প্রতিশ্রুত দূত
হিসেবে ঘোষণা করেন, যা বাবের অনুসারীরা
এত দিন ধরে আশা
করছিলেন। এরপর বাহাউল্লাহকে উসমানীয়
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নির্বাসিত করা হয় এবং
১৮৯২ সালে তাঁর মৃত্যুর
আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।
বাহাউল্লাহর
পর তাঁর পুত্র আব্দুল-বাহা এই ধর্মের
নেতৃত্ব দেন। তিনি পশ্চিমা
বিশ্বে বাহাই ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেন এবং
বাহাই শিক্ষার সামাজিক দিকগুলোর ওপর জোর দেন।
আব্দুল-বাহার পর তাঁর পৌত্র
শোগি এফেন্দি বাহাই ধর্মের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শোগি
এফেন্দি বাহাই বিশ্ব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিশ্বজুড়ে
বাহাই সম্প্রদায়ের বিস্তার ঘটান।
বাহাই
ধর্মের মূল বিশ্বাস
বাহাই
ধর্মের মূল বিশ্বাসগুলো হলো:
- এক ঈশ্বরের ধারণা: বাহাই ধর্ম অনুযায়ী, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি সকল সৃষ্টির উৎস এবং ধারক।
- ধর্মের একত্ব: বাহাই ধর্ম শিক্ষা দেয় যে, মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের প্রকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যুগে যুগে প্রেরিত নবী ও রাসূলগণ একই ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেছেন।
- মানবজাতির একত্ব: বাহাই ধর্ম বিশ্বাস করে যে, মানবজাতি একটি একক পরিবার এবং জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো প্রকার বিভেদ করা উচিত নয়।
- নারী ও পুরুষের সমতা: বাহাই ধর্ম নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের ওপর জোর দেয়।
- বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য: বাহাই ধর্ম বিজ্ঞান ও ধর্মকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখে।
- সার্বজনীন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: বাহাই ধর্ম শিক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দেয় এবং সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে চায়।
- বিশ্ব শান্তি: বাহাই ধর্ম বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করে।
বাহাই
ধর্মীয় আচার
বাহাই
ধর্মে কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয়
আচার রয়েছে, যেগুলো বাহাই সম্প্রদায়ের মানুষেরা অনুসরণ করে। এর মধ্যে
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আচার নিচে উল্লেখ
করা হলো:
- প্রার্থনা: বাহাই ধর্ম অনুযায়ী, প্রতিদিন ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থনা করা উচিত। এছাড়াও, সম্মিলিত প্রার্থনারও গুরুত্ব রয়েছে।
- উপবাস: বাহাই ক্যালেন্ডারের শেষ মাসে (সাধারণত মার্চ মাসে) উনিশ দিন ধরে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত উপবাস পালন করা হয়।
- তীর্থযাত্রা: বাহাই ধর্মাবলম্বীদের জন্য বাহাউল্লাহর জন্মস্থান ইরাকের বাগদাদ এবং ইরানের শিরাজ শহরে তীর্থযাত্রা করার বিধান রয়েছে।
- বিবাহ: বাহাই বিয়ে একটি সরল অনুষ্ঠান, যেখানে বর ও কনে ঈশ্বরের কাছে তাদের ভালোবাসার অঙ্গীকার করে।
বাহাই
ধর্মগ্রন্থ
বাহাই
ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রধান হলো বাহাউল্লাহর লেখা
'কিতাব-ই-আকদাস' (Book of Aqdas), যা বাহাই
আইনের মূল ভিত্তি। এছাড়াও,
বাহাউল্লাহর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে 'কিতাব-ই-ইকান' (Book of Certitude), 'হিডেন ওয়ার্ডস' (Hidden Words) এবং 'গ্ল্যানিংস' (Gleanings)। বাবের
লেখা 'বায়ান' (The Bayán) এবং আব্দুল-বাহা
ও শোগি এফেন্দি-এর
লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ ও চিঠিও বাহাই
ধর্মগ্রন্থের অংশ হিসেবে বিবেচিত
হয়।
গ্রন্থের নাম |
লেখকের নাম |
বিষয়বস্তু |
কিতাব-ই-আকদাস |
বাহাউল্লাহ |
বাহাই আইনের মূল ভিত্তি |
কিতাব-ই-ইকান |
বাহাউল্লাহ |
ঈশ্বরের একত্ব এবং নবীদের ধারাবাহিকতা |
হিডেন ওয়ার্ডস |
বাহাউল্লাহ |
আধ্যাত্মিক উপদেশ ও নৈতিক শিক্ষা |
গ্ল্যানিংস |
বাহাউল্লাহ |
বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত নির্বাচিত বাণী |
বায়ান |
বাব |
বাবের আইন ও শিক্ষা |
আব্দুল-বাহা-এর রচনাবলী |
আব্দুল-বাহা |
বাহাই শিক্ষার ব্যাখ্যা ও সামাজিক প্রয়োগ |
শোগি এফেন্দি-এর রচনাবলী ও
চিঠি |
শোগি এফেন্দি |
বাহাই সম্প্রদায়ের প্রশাসন ও বিশ্বজুড়ে ধর্মের
বিস্তার সম্পর্কিত নির্দেশনা |
বাহাই
ও খ্রিস্টান ধর্মের পার্থক্য
বাহাই
এবং খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য
রয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান
পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য |
বাহাই ধর্ম |
খ্রিস্টান ধর্ম |
ঈশ্বরের ধারণা |
এক ঈশ্বর, যিনি
যুগে যুগে নবী পাঠিয়েছেন |
ত্রিত্ববাদ (পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা) |
নবীর ধারণা |
বাহাউল্লাহ সর্বশেষ নবী |
যিশু খ্রিস্ট ঈশ্বরের পুত্র এবং ত্রাণকর্তা |
ধর্মগ্রন্থ |
কিতাব-ই-আকদাস, কিতাব-ই-ইকান ইত্যাদি |
বাইবেল (পুরাতন ও নতুন নিয়ম) |
পরিত্রাণ |
সৎকর্ম, ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা ও মানব সেবা |
যিশুর ওপর বিশ্বাস ও অনুগ্রহের মাধ্যমে
পরিত্রাণ |
ধর্মীয় আচার |
প্রার্থনা, উপবাস, তীর্থযাত্রা |
প্রার্থনা, উপাসনা, বাপ্তিস্ম, communion |
বাহাই
বিয়ে কী?
বাহাই
বিয়ে হলো একটি আধ্যাত্মিক
বন্ধন, যেখানে বর ও কনে
ঈশ্বরের কাছে তাদের ভালোবাসার
অঙ্গীকার করে। বাহাই বিবাহ
একটি সরল অনুষ্ঠান, যেখানে
স্থানীয় বাহাই আধ্যাত্মিক পরিষদের দুইজন সদস্যের উপস্থিতিতে বর ও কনে
নিম্নলিখিত শপথ বাক্য পাঠ
করে:
"আমরা
সকলে সত্যই ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে চলিব।"
বাহাই
ধর্মে বিবাহের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন রয়েছে,
যেমন বর ও কনের
সম্মতি এবং তাদের পরিবারের
সম্মতি প্রয়োজন।
বাহাই
কি এলজিবিটিকিউ সমর্থন করে?
বাহাই
ধর্ম লিঙ্গ পরিচয় এবং যৌনOrientation বিষয়ে
সুস্পষ্ট কোনো মতামত দেয়
না। বাহাই শিক্ষা অনুসারে, বিবাহ হলো একজন পুরুষ
ও একজন নারীর মধ্যে
একটি বন্ধন। তবে, বাহাই সম্প্রদায়
সকল মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়ার
শিক্ষা দেয়। বাহাই দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত অন্যকে সম্মান
করা এবং ভালোবাসার সাথে
আচরণ করা।
বাহাই
ধর্ম বাংলাদেশ
বাংলাদেশে
বাহাই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। বাহাই সম্প্রদায় বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম
পরিচালনা করে। বাংলাদেশে বাহাইদের
বেশ কয়েকটি স্থানীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ এবং কেন্দ্র রয়েছে,
যেখানে তারা নিয়মিতভাবে মিলিত
হন এবং তাদের ধর্মীয়
ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বাহাই কেন্দ্র ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত।
বাহাই
ধর্মের প্রার্থনা
বাহাই
ধর্মে প্রার্থনার গুরুত্ব অপরিহার্য। বাহাই ধর্ম অনুযায়ী, প্রতিদিন
ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থনা করা উচিত। বাহাউল্লাহ
বিভিন্ন ধরনের প্রার্থনার কথা উল্লেখ করেছেন,
যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পাঠ করা যায়।
একটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
"হে
আমার ঈশ্বর! আমি সাক্ষ্য দিতেছি
যে, তুমি আমাকে তোমার
পরিচয় দান করিবার জন্য
এবং তোমার প্রতি আকৃষ্ট করিবার জন্য সৃষ্টি করিয়াছ।"
বাহাই
কেন্দ্র
বিশ্বজুড়ে
বাহাইদের অনেক কেন্দ্র রয়েছে,
যেখানে তারা একত্রিত হয়ে
প্রার্থনা করে, ধর্মীয় আলোচনা
করে এবং বিভিন্ন সামাজিক
কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই কেন্দ্রগুলো
বাহাই সম্প্রদায়ের মিলনস্থল হিসেবে কাজ করে এবং
স্থানীয় समुदायের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাহাই
কেন্দ্র ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহ
জেলায় একটি বাহাই কেন্দ্র
রয়েছে, যা স্থানীয় বাহাই
সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ
স্থান। এখানে নিয়মিত প্রার্থনা সভা, ধর্মীয় আলোচনা
এবং অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। এই কেন্দ্রটি
স্থানীয় বাহাইদের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা
বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
প্রায়শই
জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্ন (FAQ)
- বাহাই ধর্ম কবে থেকে শুরু হয়?
বাহাই
ধর্ম ১৮৪৪ সালে "বাব"-এর ঘোষণার মাধ্যমে
শুরু হয়।
- বাহাই ধর্মের মূল ভিত্তি কী?
বাহাই
ধর্মের মূল ভিত্তি হলো
এক ঈশ্বরের ধারণা, সকল ধর্মের একত্ব
এবং মানবজাতির একত্ব।
- বাহাই ধর্ম কি এলজিবিটিকিউ সমর্থন করে?
বাহাই
ধর্ম লিঙ্গ পরিচয় এবং যৌনOrientation বিষয়ে
সুস্পষ্ট কোনো মতামত দেয়
না, তবে সকলকে সম্মান
করার শিক্ষা দেয়।
- বাহাই বিয়ে কী?
বাহাই
বিয়ে হলো বর ও
কনের মধ্যে ঈশ্বরের কাছে ভালোবাসার অঙ্গীকার।
- বাহাই ধর্মগ্রন্থ কী কী?
প্রধান
ধর্মগ্রন্থ হলো কিতাব-ই-আকদাস, কিতাব-ই-ইকান, হিডেন
ওয়ার্ডস এবং গ্ল্যানিংস।
- বাংলাদেশে বাহাইদের কার্যক্রম কী?
বাংলাদেশে
বাহাইরা বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম
পরিচালনা করে।
বাহাই
ধর্ম মানবজাতির ঐক্য, শান্তি ও প্রগতির জন্য
নিবেদিত একটি ধর্ম। এর
শিক্ষাগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে একটি নতুন আশা
জাগিয়েছে।