কুরআন এবং হাদিসের আলোকে কুরবানির ইতিহাস, গুরুত্ব এবং ফজিলত

কুরআন এবং হাদিসের আলোকে কুরবানির ইতিহাস, গুরুত্ব এবং ফজিলত

কুরবানি আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ নৈকট্য লাভ করা বা উৎসর্গ করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে নির্দিষ্ট প্রকারের হালাল গৃহপালিত পশু জবাই করাকে কুরবানি বলে। এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আত্মত্যাগ, আনুগত্য এবং আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতীক। কুরআন এবং হাদিসের আলোকে কুরবানির তাৎপর্য অপরিসীম

কুরআন এবং হাদিসের আলোকে কুরবানির ইতিহাস

কুরবানির ইতিহাস মানবেতিহাসের মতোই প্রাচীন। পবিত্র কুরআনে মানবজাতির আদি পিতা আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানির ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এটিই পৃথিবীর প্রথম কুরবানি। তাদের কুরবানি ছিল আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করা এবং ভূগর্ভস্থ ফসল উৎসর্গ করা। আল্লাহ তায়ালা হাবিলের (পশু) কুরবানি কবুল করেছিলেন তাঁর তাকওয়া ও নিষ্ঠার কারণে, কিন্তু কাবিলের (ফসল) কুরবানি কবুল করেননি। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ শুধু বাহ্যিক আমল দেখেন না, বরং অন্তরের তাকওয়া ও নিষ্ঠাই মুখ্য। (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৭)

তবে বর্তমানে আমরা যে কুরবানির প্রথা পালন করি, তা মূলত মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ)-এর সুমহান আত্মত্যাগের স্মৃতিবাহী। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন যে, ইব্রাহিম (আঃ) স্বপ্নে দেখলেন তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে আল্লাহর পথে কুরবানি করছেন। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এক কঠিন পরীক্ষা। ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর আদেশ পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। তিনি তার প্রিয়তম পুত্র ইসমাইল (আঃ)-এর মতামত জানতে চাইলে, কিশোর ইসমাইল (আঃ) বিনাদ্বিধায় জবাব দিলেন, "হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।" (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)

পিতা-পুত্র উভয়েরই ছিল আল্লাহর আদেশের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। যখন ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর পুত্রকে কুরবানির জন্য প্রস্তুত করলেন এবং ছুড়ি চালাচ্ছিলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে ডেকে বললেন, "হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ! এভাবেই আমরা নেককারদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমরা এক মহান কুরবানির বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম।" (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৪-১০৭) আল্লাহ তায়ালা ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন, যা ইব্রাহিম (আঃ) কুরবানি করলেন

এই ঐতিহাসিক ঘটনা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অবিস্মরণীয় আদর্শ। তাকওয়া, আনুগত্য, ধৈর্য এবং আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা স্থাপিত হয়েছে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। প্রতি বছর মুসলিমরা এই কুরবানি পালনের মাধ্যমে ইব্রাহিম (আঃ)-এর সেই মহান স্মৃতিকেই স্মরণ করে এবং আল্লাহর প্রতি তাদের আনুগত্য ও ভালোবাসাকে প্রমাণ করে

কুরআন এবং হাদিসের আলোকে কুরবানির গুরুত্ব

ইসলামে কুরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি নিছক একটি পশুজবাই নয়, বরং এর সাথে জড়িত রয়েছে এক গভীর আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক তাৎপর্য

১. আল্লাহর নৈকট্য লাভ: কুরবানির মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করা। সূরা হজ্বের ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন:

"এগুলোর মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।" অর্থাৎ, কুরবানির পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না; বরং কুরবানির পেছনের নিয়ত, তাকওয়া ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসাটাই আল্লাহর কাছে মূল্যবান

২. ইব্রাহিম (আঃ)-এর সুন্নাহর পুনরুজ্জীবন: কুরবানি মুসলিমদের পিতা ইব্রাহিম (আঃ)-এর সেই মহান আত্মত্যাগের আদর্শের অনুসরণ। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর আনুগত্যে নিজেদের উৎসর্গ করার দীক্ষা লাভ করি

৩. আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: কুরবানি আল্লাহ তায়ালার দেওয়া অসংখ্য নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের একটি মাধ্যম। আল্লাহর পথে কিছু উৎসর্গ করার মাধ্যমে বান্দা তার সম্পদের মোহ ত্যাগ করে এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে

৪. সামাজিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি: কুরবানির গোশত বিতরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক রীতি। এর মাধ্যমে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং বিশেষ করে দরিদ্র ও মিসকিনদের হক আদায় হয়। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া এবং ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে কুরবানির বিশাল ভূমিকা রয়েছে

৫. একটি বিশেষ ইবাদত: কুরবানি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করতে হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে কুরবানি করেছেন এবং এর প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন

বিভিন্ন হাদিস থেকে কুরবানির গুরুত্ব স্পষ্ট বোঝা যায়:

  • আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: "কুরবানির দিনের চেয়ে আল্লাহর কাছে অন্য কোনো আমল অধিক প্রিয় নয়। কুরবানির পশুর শিং, পশম, এবং পায়ের ক্ষুর কিয়ামতের দিন ওজনের পাল্লায় এসে যাবে। আর কুরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট পৌঁছে যায়।" (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ) এই হাদিসটি কুরবানির ফজিলতের পাশাপাশি এর গুরুত্বও তুলে ধরে
  • আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: "যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।" (ইবনে মাজাহ, আহমাদ)। এই হাদিসটি প্রমাণ করে যে, কুরবানি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য এটি পরিত্যাগ করা উচিত নয়। অনেক উলামায়ে কেরাম এই ও এই ধরণের হাদিসের উপর ভিত্তি করে কুরবানিকে ওয়াজিব বলেছেন, যদিও অধিকাংশ ফকিহ এটিকে সুন্নাহ মুআক্কাদাহ (অত্যন্ত জোরালোভাবে উৎসাহিত সুন্নাহ) বলেছেন। তবে এতে এর গুরুত্ব এতটুকুও কমে যায় না

কুরবানির ফজিলত

কুরবানির সাথে বহু ফজিলত জড়িত, যা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কুরবানি কেবল একটি আর্থিক ইবাদত নয়, এর আধ্যাত্মিক প্রতিদান অনেক বড়

কুরবানির উল্লেখযোগ্য ফজিলতগুলো হলো:

  • আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল: ঈদুল আজহার দিনে কুরবানি আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ইবাদত। হাদিসে এসেছে যে, কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়
  • কিয়ামতের দিন পশুর প্রতিটি অংশের প্রতিদান লাভ: কুরবানির পশুর শিং, পশম, ক্ষুর সবকিছুই কিয়ামতের দিন বান্দার নেকীর পাল্লায় ওজন করা হবে
  • গুনাহ মাফ হওয়ার সম্ভাবনা: অনেক উলামা মনে করেন যে, কুরবানির মাধ্যমে গুনাহ মাফ হওয়ার আশা করা যায়, বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হলে। এটি তাকওয়া এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ফল
  • আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: কুরবানির মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে, যা মুমিনের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য
  • ইব্রাহিম (আঃ)-এর সুন্নত পালনের সওয়াব: ফাদ্বিলতপূর্ণ এই সুন্নতটি পালনের জন্য বান্দা বিশেষ প্রতিদান লাভ করে
  • দরিদ্র ও অভাবীদের সাহায্য: কুরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে অভাবী ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো হয়, যা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় একটি কাজ

কুরবানির নিয়মকানুন (সংক্ষেপে)

যদিও নিয়মকানুন স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়, তবে গুরুত্ব ও ফজিলতের সাথে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কিছু মৌলিক নিয়ম উল্লেখ করা হল:

  • সময়: কুরবানির সময় হলো ঈদুল আজহার দিনের নামাজ আদায়ের পর থেকে আইয়ামে তাশরীকের (জিলহজের ১১ ও ১২ তারিখ) সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। উত্তম সময় হলো ঈদের দিনের পর
  • কার উপর ওয়াজিব/সুন্নত: প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর কুরবানি ওয়াজিব অথবা সুন্নাহ মুআক্কাদাহ (মতানৈক্য রয়েছে), যার কাছে কুরবানির দিনগুলোতে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা তার সমমূল্যের সম্পদ প্রয়োজন অতিরিক্ত থাকে
  • পশু:
    • উট, গরু/মহিষ, দুম্বা/ভেড়া/ছাগল
    • পশুর নির্দিষ্ট বয়স হওয়া জরুরি: উট ৫ বছর, গরু/মহিষ ২ বছর, দুম্বা/ভেড়া/ছাগল ১ বছর (ভেড়া/দুম্বা ৬ মাসের হলেও যদি দেখতে এক বছরের মতো লাগে, তবে জায়েজ)
    • পশু সুস্থ ও ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। অন্ধত্ব, খোঁড়া হওয়া, কান কাটা বা ছেঁড়া থাকা (অতিরিক্ত), লেজ কাটা বা ভাঙা থাকা (অতিরিক্ত), অতিরিক্ত শুকনো বা দুর্বল হওয়া ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত পশু দিয়ে কুরবানি করা যায় না
  • অংশীদারিত্ব: ছাগল, দুম্বা, ভেড়ায় একজন অংশীদার হতে পারে। গরু, মহিষ, উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরীক হতে পারে। সব শরীকের নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকতে হবে
  • মাংস বিতরণ: কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব (উত্তম):
    • এক ভাগ নিজের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের জন্য
    • এক ভাগ বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীর জন্য
    • এক ভাগ দরিদ্র ও অভাবীদের জন্য। তবে এই বণ্টন বাধ্যতামূলক নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী কমবেশি করা যেতে পারে, কিন্তু দরিদ্রদের হক আদায় করা জরুরি

গৃহপালিত পশুর কুরবানির জন্য বয়সের তালিকা

পশুর প্রকারভেদ

ন্যূনতম বয়স

সর্বোচ্চ অংশীদার

উট (Camel)

৫ বছর

১-৭ জন

গরু/মহিষ (Cow/Buffalo)

২ বছর

১-৭ জন

দুম্বা/ভেড়া (Sheep/Ram)

১ বছর*

১ জন

ছাগল (Goat)

১ বছর

১ জন

(*দ্রষ্টব্য: ভেড়া বা দুম্বা ছয় মাসের হলেও যদি এক বছরের ভেড়া বা দুম্বার মতো হৃষ্টপুষ্ট হয়, তবে তা দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ।)

প্রাসঙ্গিক কুরআনের আয়াত ও হাদিস

কুরআন এবং হাদিসে কুরবানি সম্পর্কে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে

  • সূরা কাওসার এর ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন: "সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো।" এই আয়াতে সালাতের পাশাপাশি কুরবানির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা ইবাদত হিসেবে এর গুরুত্ব প্রমাণ করে
  • জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঈদের দিন দু’টি হৃষ্টপুষ্ট ও শিংযুক্ত দুম্বা কুরবানি করলেন। যখন তিনি তাদের কিবলামুখী করলেন, তখন বললেন: "আমি আমার চেহারা একনিষ্ঠভাবে সেই সত্ত্বার দিকে ফিরালাম, যিনি আকাশ ও পৃথিবীসমূহ সৃষ্টি করেছেন। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার সালাত, আমার নুসুক (কুরবানি), আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্যই, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর আমাকে এর নির্দেশই দেওয়া হয়েছে এবং আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা (হে আল্লাহ! এই কুরবানি তোমার তরফ থেকে এবং তোমারই জন্য)। মুহাম্মাদ ও তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে (কুরবানি করলাম)। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।" অতঃপর তিনি জবাই করলেন। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমী)

এই হাদিসটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিজের কুরবানির পদ্ধতি এবং কুরবানির সময় পঠিতব্য দু'আ বা নিয়ত সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়। এটি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও বশ্যতার ঘোষণা

সচরাচর জিজ্ঞাস্য (FAQs)

১. কুরবানি কি ওয়াজিব নাকি সুন্নাহ? এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ সাহাবী, তাবেঈন এবং ফকিহ যেমন ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ (রহঃ) এর মতে, কুরবানি সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য সুন্নাহ মুআক্কাদাহ (অত্যন্ত জোরালোভাবে উৎসাহিত সুন্নাহ)। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর মতে, সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব। হাদিসের ভাষার জোরালো ভাব এবং রাসূল (সাঃ)-এর নিয়মিত আমলের কারণে এর গুরুত্ব ওয়াজিবের কাছাকাছি

২. কুরবানির পশুর চামড়া কী করব? কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে তার মূল্য দরিদ্র ও অভাবীদের সাদকা করে দিতে হবে। এই মূল্য কুরবানির সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। চামড়া নিজেরা ব্যবহার করতে চাইলে ব্যবহার করা জায়েজ আছে

৩. কুরবানির গোশত কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে? কুরবানির গোশত যতদিন ইচ্ছাবোনি সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যদি নষ্ট হওয়ার ভয় না থাকে। পূর্বে একটি হাদিসে তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করতে নিষেধ করা হয়েছিল, যা ছিল বিশেষ অবস্থার জন্য। পরবর্তীতে রাসূল (সাঃ) এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন

৪. একটি গরুতে কতজন শরীক হতে পারে? একটি গরু বা মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরীক হতে পারে। তবে উটেও সাতজন শরীক হতে পারে। ছাগল, দুম্বা বা ভেড়ায় একজনই কুরবানি দিতে হয়

৫. যদি কেউ ঋণ করে কুরবানি করে? যদি কারো কুরবানি করার মতো সামর্থ্য না থাকে, কিন্তু ঋণ করে কুরবানি করলে পরবর্তীতে সেই ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে সে নিশ্চিত থাকে, তবে ঋণ করে কুরবানি করা জায়েজ আছে। তবে যদি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা থাকে, তাহলে ঋণ করে কুরবানি করা উচিত নয়। আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যের বাইরে কিছু চাপিয়ে দেন না

উপসংহার

কুরবানি কেবল একটি বার্ষিক প্রথা পালন নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্য, ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের গভীর নিদর্শন। ইব্রাহিম (আঃ)-এর সেই মহান সুন্নতকে স্মরণ করে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পশু কুরবানি করি। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন আল্লাহর আদেশ পালন করে বিপুল সওয়াব অর্জন করা যায়, তেমনি অন্যদিকে সমাজের দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সামাজিক ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপন করা যায়। কুরবানির মাংসের প্রতিটি কণা, পশুর প্রতিটি পশম আল্লাহর কাছে বান্দার আমলনামায় নেকী হিসেবে জমা হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের কুরবানি কবুল করুন এবং এর প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন। আমীন

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url