জৈন ধর্ম: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

 জৈন ধর্ম: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

জৈন ধর্ম: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

জৈন ধর্ম ভারতের অন্যতম প্রাচীন ধর্মমত। এটি অহিংসা আত্ম-সংযমের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। 'জৈন' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'জিন' থেকে, যার অর্থ 'জয়ী' যিনি কামনা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদির মতো ভেতরের আবেগগুলোকে জয় করে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান (কেবল জ্ঞান) লাভ করেন, তাকেই 'জিন' বলা হয়। 'জিন'দের দেখানো পথ যারা অনুসরণ করেন, তারাই 'জৈন'

উৎপত্তি ইতিহাস

জৈন ধর্ম শ্রমণ প্রথা থেকে উদ্গত একটি ধর্মমত। জৈনদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই ধর্মে মোট ২৪ জন তীর্থঙ্কর ছিলেন, যাদের শিক্ষা এই ধর্মের মূল ভিত্তি।

  • প্রথম তীর্থঙ্কর: ঋষভনাথ।
  • ২৩তম তীর্থঙ্কর: পার্শ্বনাথ, যিনি প্রায় আড়াইশ বছর আগে শিক্ষা প্রচার করেন।
  • ২৪তম সর্বশেষ তীর্থঙ্কর: মহাবীর বর্ধমান। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ থেকে ৪৬৮ অব্দ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন এবং গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। মহাবীর জৈন ধর্মের প্রসার সুসংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

জৈন বিশ্বাস অনুসারে, মহাবীরের আগেও জৈন ধর্ম প্রচলিত ছিল এবং মহাবীর এই ধর্মের কোনো নতুন প্রতিষ্ঠাতা নন, বরং তিনি পূর্ববর্তী তীর্থঙ্করদের শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত সুসংগঠিত করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে জৈন ধর্মাবলম্বীরা শ্বেতাম্বর দিগম্বরএই দুটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

জৈন ধর্মের মূলনীতি বিশ্বাস

জৈন ধর্মের তিনটি প্রধান স্তম্ভ হলো:

  • অহিংসা (Non-violence): এটি জৈন ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতি। জৈনরা বিশ্বাস করে, প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই প্রাণ বা আত্মা রয়েছে। তাই কোনো প্রাণীকে আঘাত করা বা ক্ষতি করা পাপ। এই নীতি কেবল শারীরিক হিংসার ক্ষেত্রেই নয়, বরং চিন্তা কথার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এর জন্য জৈনরা অত্যন্ত কঠোরভাবে নিরামিষাশী জীবনযাপন করে। তারা এমনকি পেঁয়াজ, রসুন এবং মাটির নিচে জন্মানো সবজি যেমন আলু, গাজরও খায় না, কারণ এই সবজিগুলো তোলার সময় ছোট পোকামাকড় বা অণুজীবের ক্ষতি হতে পারে। অনেক জৈন সন্ন্যাসী মুখে মাস্ক পরেন যাতে নিঃশ্বাসের সাথে কোনো ক্ষুদ্র প্রাণীর ক্ষতি না হয় এবং হাঁটার সময় মেঝে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে হাঁটেন।
  • অনেকান্তবাদ (Non-absolutism/Many-sided reality): এই নীতি অনুসারে, সত্য বাস্তবতা বহু-মাত্রিক। কোনো একক দৃষ্টিভঙ্গিই সম্পূর্ণ সত্যকে ধারণ করতে পারে না। এটি অন্যের মতামত বিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতা শ্রদ্ধাবোধ শেখায়।
  • অপরিগ্রহ (Non-possessiveness/Non-attachment): এটি অনাসক্তি সম্পত্তির প্রতি কম আসক্তির ধারণাকে বোঝায়। জৈনরা বিশ্বাস করে যে জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্তি দুঃখ কর্মফলের কারণ। সন্ন্যাসীরা সম্পূর্ণভাবে জাগতিক বস্তুর মায়া ত্যাগ করেন, আর সাধারণ মানুষও তাদের সম্পত্তি সীমিত রাখার চেষ্টা করেন।

পঞ্চ মহাব্রত

জৈন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীরা পাঁচটি প্রধান ব্রত পালন করেন, যা পঞ্চ মহাব্রত নামে পরিচিত। সাধারণ গৃহী মানুষেরা এই ব্রতগুলোকে কিছুটা শিথিলভাবে অণু ব্রত হিসেবে পালন করেন।

  1. অহিংসা (Non-violence): কোনো জীবিত প্রাণীর ক্ষতি না করা।
  2. সত্য (Truthfulness): সর্বদা সত্য কথা বলা এবং মিথ্যা পরিহার করা।
  3. অস্তেয় (Non-stealing): চুরি না করা বা অন্যের অনুমতি ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণ না করা।
  4. ব্রহ্মচর্য (Chastity): সন্ন্যাসীদের জন্য সম্পূর্ণ ব্রহ্মচর্য এবং গৃহীদের জন্য সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ততা ইন্দ্রিয়সুখ নিয়ন্ত্রণ।
  5. অপরিগ্রহ (Non-possessiveness): জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস জমা না করা।

ত্রিরত্ন (Three Jewels)

জৈন ধর্মে কর্মফল পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি (মোক্ষ বা নির্বাণ) লাভের জন্য তিনটি মূলনীতি বা আদর্শ পালনের কথা বলা হয়েছে। এগুলোকে একত্রে ত্রিরত্ন বলা হয়:

  • সম্যক দর্শন (সৎ বিশ্বাস): সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জৈন ধর্মের মূলনীতিগুলোর প্রতি অবিচল বিশ্বাস।
  • সম্যক জ্ঞান (সৎ জ্ঞান): সঠিক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন, যা জগৎ আত্মার প্রকৃতিকে বোঝায়।
  • সম্যক চরিত্র (সৎ আচরণ): পঞ্চ মহাব্রত এবং অন্যান্য নৈতিক নিয়ম মেনে চলা।

উৎসব

জৈন ধর্মের কিছু প্রধান উৎসব হলো:

  • মহাবীর জয়ন্তী: জৈন ধর্মের ২৪তম শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের জন্ম উদযাপন করা হয়। এটি জৈনদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, যা সাধারণত মার্চ বা এপ্রিল মাসে পালিত হয়।
  • পর্যুষণ: এটি একটি আট-দিনব্যাপী আত্মশুদ্ধি ক্ষমা চাওয়ার উৎসব। এই সময়ে জৈনরা উপবাস, ধ্যান এবং ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে।
  • দীপাবলি: হিন্দুদের দীপাবলির মতো জৈনরাও এই উৎসব পালন করে, তবে তাদের কাছে এটি মহাবীরের নির্বাণ (মোক্ষ) লাভের দিন হিসেবে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

জৈন ধর্মাবলম্বী

বর্তমানে বিশ্বে জৈন ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও ভারতে এদের প্রভাব বেশ লক্ষণীয়, বিশেষ করে শিক্ষা অর্থনীতিতে। জৈনরা তাদের প্রাচীন গ্রন্থাগার এবং উচ্চ সাক্ষরতার হারের জন্য পরিচিত। তারা বিশ্বাস করে যে এই ধর্ম মানুষকে আত্ম-অনুসন্ধান আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যমে মোক্ষ লাভে সাহায্য করে।

জৈন ধর্ম তার কঠোর অহিংসার নীতি এবং আত্ম-সংযমের শিক্ষাদানের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত।


প্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট করুনTech News BD

ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট করুনThe Divine Path

খেলাধূলা বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট করুনSports Bangladesh

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url