ইয়াজিদি ধর্ম একটি প্রাচীন ও রহস্যময় ধর্মীয় সম্প্রদায়, যা মূলত ইরাকের কুর্দিস্তানে বাস করে, তবে তুরস্ক, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছে। এরা নিজেদের ঐতিহ্য এবং স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয়কে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে আসছে। নিচে ইয়াজিদি ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো:
১.
উৎপত্তি ও ইতিহাস:
- ইয়াজিদি ধর্ম প্রাচীন ইয়াজদানিজম থেকে এসেছে, যা প্রাক-ইসলামিক যুগে কুর্দিদের ধর্ম ছিল।
- জরথুস্ত্রবাদ, ইসলাম, খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইহুদি ধর্মের কিছু উপাদানের সংমিশ্রণে বর্তমান ইয়াজিদি ধর্মের রূপ নিয়েছে।
- শেখ আদি ইবন মুসাফির (একাদশ-দ্বাদশ শতক) ইয়াজিদিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একজন ব্যক্তি। তার মাজার ইরাকের লালিশে অবস্থিত, যা তাদের প্রধান তীর্থস্থান।
- ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে, তারা কেবল হযরত আদম (আ.)-এর বংশধর। আদমের (আ.) সন্তানের সঙ্গে জনৈকা হুরির বিবাহের পরিণতিতে পৃথিবীতে ইয়াজিদিদের সৃষ্টি হয়।
২.
ধর্ম বিশ্বাস ও দেবদেবী:
- একত্ববাদ: ইয়াজিদিরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, যাকে তারা 'ইয়াজদান' বা 'খোয়েদে' বলে ডাকে। তারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সরাসরি এর রক্ষণাবেক্ষণে জড়িত নন।
- সাত পবিত্র সত্তা/ফেরেশতা: ঈশ্বর বিশ্ব পরিচালনার জন্য সাতজন পবিত্র সত্তা বা ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। এদের মধ্যে প্রধান হলেন 'তাউসি মালেক' (ময়ূর ফেরেশতা)।
- তাউসি মালেক (ময়ূর ফেরেশতা): ইয়াজিদি ধর্মে তাউসি মালেক কেন্দ্রীয় চরিত্র। বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈশ্বর যখন আদমকে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি ফেরেশতাদের আদমকে সেজদা করার নির্দেশ দেন। তাউসি মালেক ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে একমাত্র ঈশ্বরই সেজদার যোগ্য। এই অস্বীকৃতিকে ইয়াজিদিরা অহংকার নয় বরং ঈশ্বরের প্রতি চরম ভক্তি হিসেবে দেখে। এর জন্য তাউসি মালেককে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে তিনি ক্ষমা লাভ করেন এবং ফেরেশতাদের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। এই কারণেই কিছু গোষ্ঠী ভুলবশত ইয়াজিদিদের 'শয়তানের পূজারি' বলে আখ্যায়িত করে, যদিও ইয়াজিদিরা শয়তানে বিশ্বাস করে না এবং পাপের উৎস হিসেবে শয়তানকে মানে না। তাদের মতে, মন্দ মানুষের ভেতর থেকে আসে।
- পুনর্জন্ম: ইয়াজিদিরা পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী।
- পবিত্রতা: তারা ঈশ্বরকে এত পবিত্র মনে করে যে সরাসরি তার উপাসনা করে না, বরং তাউসি মালেক এবং অন্যান্য ফেরেশতাদের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে।
- প্রকৃতি পূজা: ইয়াজিদিরা প্রকৃতিকে সম্মান করে। তাদের মন্দিরের ফটকে কালো রঙের সাপের প্রতিকৃতি থাকে, যাকে তারা 'প্রকৃতির মা' হিসেবে বিবেচনা করে এবং তারা কখনও সাপ হত্যা করে না। আগুন, জল, বায়ু এবং পৃথিবী তাদের কাছে পবিত্র উপাদান।
- আদম-হাওয়া সম্পর্কিত ধারণা: ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে যে হযরত আদম (আ.) পবিত্র ছিলেন কিন্তু বিবি হাওয়া (আ.) নন। তাই অন্যান্য ধর্মের লোকেরা আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.)-এর মিলন থেকে আসায় তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ মিশে আছে, কিন্তু ইয়াজিদিরা কেবল আদমের বংশধর হওয়ায় তারা পবিত্রতম।
৩.
ধর্মীয় রীতি ও প্রথা:
- প্রার্থনা: ইয়াজিদিরা দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করত, তবে বর্তমানে তারা মূলত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় প্রার্থনা করে। সূর্যোদয়ের প্রার্থনার সময় সূর্যের দিকে এবং সূর্যাস্তের সময় লালিশের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করে। বহিরাগতদের উপস্থিতিতে তাদের দিবসের প্রার্থনা হয় না।
- পবিত্র দিন ও বিশ্রাম দিবস: বুধবার তাদের পবিত্র দিন এবং শনিবার বিশ্রাম দিবস।
- লালিশ তীর্থযাত্রা: ইরাকের উত্তর মসুলের লালিশে অবস্থিত শেখ আদি ইবনে মুসাফিরের মাজারে সাত দিনের হজ্বব্রত বা তীর্থ ভ্রমণ তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি। তীর্থ ভ্রমণের সময় তারা নদীতে গোসল করে, তাউসি মালেকের মূর্তি ধৌত করে এবং শেখ সাদির মাজারে শত প্রদীপ জ্বালায়। এ সময় তারা ষাঁড় কোরবানি করে।
- দীক্ষা: ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানদের মতো ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের শিশুদের সর্বাঙ্গ পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে একজন 'পীর' দীক্ষা দেন।
- রোজা: ডিসেম্বর মাসে ইয়াজিদিরা তিন দিন রোজা রাখে।
- বিবাহ: ইয়াজিদিরা নিজেদের সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করে না এবং তাদের ধর্মের মধ্যে নির্দিষ্ট জাতিগত শ্রেণীবিভাগের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তারা অন্য ধর্মের কাউকে ইয়াজিদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে দেয় না।
- উৎসব: তাদের প্রধান উৎসবগুলির মধ্যে রয়েছে 'খেদ্র নবী' (ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে পালিত হয়) এবং 'সামোইয়া সারে সালে' (এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পালিত ইয়াজিদি নববর্ষ)।
৪.
বর্তমান অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ:
- ইয়াজিদিরা পৃথিবীর অন্যতম নির্যাতিত ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। ইসলামিক স্টেট (আইএস) সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের 'শয়তানের উপাসক' আখ্যা দিয়ে গণহত্যা ও নির্যাতনে চালিয়েছে।
- বিশ্বব্যাপী তাদের সংখ্যা প্রায় ৮-১০ লাখ। ইরাক ও সিরিয়ার শরণার্থী ক্যাম্পগুলিতে হাজার হাজার ইয়াজিদি বাস করছে। অনেকে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় পুনর্বাসিত হয়েছেন।
ইয়াজিদি
ধর্ম একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস
এবং স্বতন্ত্র বিশ্বাস নিয়ে গঠিত একটি ধর্মীয়
ঐতিহ্য, যা তার অনুসারীদের
জন্য গভীর তাৎপর্য বহন
করে।
ইয়াজিদি
ধর্ম সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর:
১.
ইয়াজিদি ধর্ম কী? ইয়াজিদি ধর্ম একটি প্রাচীন
ও রহস্যময় ধর্মীয় সম্প্রদায়, যা মূলত ইরাকের
কুর্দিস্তানে বাস করে ।
এছাড়া তুরস্ক, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও
এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছে ।
২.
ইয়াজিদি ধর্মের উৎপত্তি ও ইতিহাস কী? ইয়াজিদি ধর্ম প্রাচীন ইয়াজদানিজম
থেকে এসেছে, যা প্রাক-ইসলামিক
যুগে কুর্দিদের ধর্ম ছিল ।
জরথুস্ত্রবাদ, ইসলাম, খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইহুদি
ধর্মের কিছু উপাদানের সংমিশ্রণে
বর্তমান ইয়াজিদি ধর্মের রূপ নিয়েছে ।
শেখ আদি ইবন মুসাফির
(একাদশ-দ্বাদশ শতক) ইয়াজিদিদের কাছে
অত্যন্ত পবিত্র একজন ব্যক্তি ।
তার মাজার ইরাকের লালিশে অবস্থিত, যা তাদের প্রধান
তীর্থস্থান । ইয়াজিদিরা বিশ্বাস
করে, তারা কেবল হযরত
আদম (আ.)-এর বংশধর
। আদমের (আ.) সন্তানের সঙ্গে
জনৈকা হুরির বিবাহের পরিণতিতে পৃথিবীতে ইয়াজিদিদের সৃষ্টি হয় ।
৩.
ইয়াজিদিদের প্রধান ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো কী কী? ইয়াজিদিরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস
করে, যাকে তারা 'ইয়াজদান'
বা 'খোয়েদে' বলে ডাকে ।
তারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর
এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সরাসরি এর রক্ষণাবেক্ষণে জড়িত
নন । ঈশ্বর বিশ্ব
পরিচালনার জন্য সাতজন পবিত্র
সত্তা বা ফেরেশতা সৃষ্টি
করেছেন । এদের মধ্যে
প্রধান হলেন 'তাউসি মালেক' (ময়ূর ফেরেশতা) । তাউসি মালেক
ইয়াজিদি ধর্মে কেন্দ্রীয় চরিত্র । ইয়াজিদিরা পুনর্জন্মবাদে
বিশ্বাসী । তারা ঈশ্বরকে
এত পবিত্র মনে করে যে
সরাসরি তার উপাসনা করে
না, বরং তাউসি মালেক
এবং অন্যান্য ফেরেশতাদের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে
। ইয়াজিদিরা প্রকৃতিকে সম্মান করে । আগুন,
জল, বায়ু এবং পৃথিবী তাদের
কাছে পবিত্র উপাদান ।
৪.
তাউসি মালেক কে এবং ইয়াজিদি ধর্মে তার ভূমিকা কী? তাউসি মালেক ইয়াজিদি ধর্মে কেন্দ্রীয় চরিত্র । বিশ্বাস অনুযায়ী,
ঈশ্বর যখন আদমকে সৃষ্টি
করেন, তখন তিনি ফেরেশতাদের
আদমকে সেজদা করার নির্দেশ দেন
। তাউসি মালেক ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে
আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করেন,
কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন
যে একমাত্র ঈশ্বরই সেজদার যোগ্য । এই অস্বীকৃতিকে
ইয়াজিদিরা অহংকার নয় বরং ঈশ্বরের
প্রতি চরম ভক্তি হিসেবে
দেখে । এর জন্য
তাউসি মালেককে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে তিনি ক্ষমা
লাভ করেন এবং ফেরেশতাদের
প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন । এই
কারণেই কিছু গোষ্ঠী ভুলবশত
ইয়াজিদিদের 'শয়তানের পূজারি' বলে আখ্যায়িত করে,
যদিও ইয়াজিদিরা শয়তানে বিশ্বাস করে না এবং
পাপের উৎস হিসেবে শয়তানকে
মানে না । তাদের
মতে, মন্দ মানুষের ভেতর
থেকে আসে ।
৫.
ইয়াজিদিদের প্রার্থনা ও উৎসবগুলো কেমন? ইয়াজিদিরা দিনে পাঁচবার প্রার্থনা
করত, তবে বর্তমানে তারা
মূলত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়
প্রার্থনা করে । সূর্যোদয়ের
প্রার্থনার সময় সূর্যের দিকে
এবং সূর্যাস্তের সময় লালিশের দিকে
মুখ করে প্রার্থনা করে
। বুধবার তাদের পবিত্র দিন এবং শনিবার
বিশ্রাম দিবস । ইরাকের
উত্তর মসুলের লালিশে অবস্থিত শেখ আদি ইবনে
মুসাফিরের মাজারে সাত দিনের হজ্বব্রত
বা তীর্থ ভ্রমণ তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি । ডিসেম্বর
মাসে ইয়াজিদিরা তিন দিন রোজা
রাখে । তাদের প্রধান
উৎসবগুলির মধ্যে রয়েছে 'খেদ্র নবী' (ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে পালিত
হয়) এবং 'সামোইয়া সারে
সালে' (এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পালিত ইয়াজিদি নববর্ষ) ।
৬.
ইয়াজিদিরা আদম ও হাওয়া সম্পর্কে কী বিশ্বাস করে? ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে যে হযরত
আদম (আ.) পবিত্র ছিলেন
কিন্তু বিবি হাওয়া (আ.)
নন । তাই অন্যান্য
ধর্মের লোকেরা আদম (আ.) ও
বিবি হাওয়া (আ.)-এর মিলন
থেকে আসায় তাদের মধ্যে
ভালো-মন্দ মিশে আছে,
কিন্তু ইয়াজিদিরা কেবল আদমের বংশধর
হওয়ায় তারা পবিত্রতম ।
৭.
ইয়াজিদিরা কেন নির্যাতনের শিকার হয়? ইয়াজিদিরা পৃথিবীর অন্যতম নির্যাতিত ধর্মীয় জনগোষ্ঠী । ইসলামিক স্টেট
(আইএস) সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী
তাদের 'শয়তানের উপাসক' আখ্যা দিয়ে গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছে
।
৮.
বর্তমানে ইয়াজিদিদের অবস্থা কেমন? বিশ্বব্যাপী তাদের সংখ্যা প্রায় ৮-১০ লাখ
। ইরাক ও সিরিয়ার
শরণার্থী ক্যাম্পগুলিতে হাজার হাজার ইয়াজিদি বাস করছে ।
অনেকে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় পুনর্বাসিত
হয়েছেন ।
প্রযুক্তি
বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট
করুন: Tech News BD
ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট
করুন: The Divine Path
খেলাধূলা বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট
করুন: Sports Bangladesh