ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা ও আধুনিক উদযাপন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী: ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা ও আধুনিক উদযাপন
ভগবান
শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়,
এটি কোটি কোটি হিন্দু
ধর্মাবলম্বীর হৃদয়ের এক গভীর আধ্যাত্মিক
উদযাপন। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের
কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই পুণ্যতিথি পালিত
হয়, যা শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যে
আবির্ভাবের স্মারক। এই দিনটি কেবল
আনন্দের নয়, এটি ধর্ম,
কর্ম এবং ভক্তির এক
মহিমান্বিত সংমিশ্রণ। শ্রীকৃষ্ণের জীবন ছিল জ্ঞান,
প্রেম, সাহস এবং ন্যায়ের
এক অবিচ্ছিন্ন স্রোতধারা। তাঁর জন্ম হয়েছিল
এক ঘোর অন্ধকার যুগে,
যখন অধর্ম ও অন্যায় চরম
সীমায় পৌঁছেছিল। তাঁর আবির্ভাব ছিল
অশুভ শক্তির বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের
এক দৈব প্রতিশ্রুতি। এই
নিবন্ধে আমরা জন্মাষ্টমীর ইতিহাস,
ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি, আধুনিক উদযাপন পদ্ধতি, শ্রীকৃষ্ণের দার্শনিক শিক্ষা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের
উদযাপনের বৈচিত্র্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১.
জন্মাষ্টমীর ইতিহাস ও তাৎপর্য
শ্রীকৃষ্ণের
জন্মের পটভূমি পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণ মথুরার কংসের কারাগারে দেবকী ও বসুদেবের অষ্টম
সন্তান রূপে জন্মগ্রহণ করেন।
কংস ছিলেন দেবকীর ভাই এবং একজন
অত্যাচারী রাজা। এক দৈববাণী তাঁকে
সতর্ক করে যে দেবকীর
অষ্টম সন্তানের হাতে তাঁর মৃত্যু
হবে। এই ভয়ে কংস
দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে
বন্দী করে রাখেন এবং
তাঁদের ছয়টি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। যখন সপ্তম গর্ভে
বলরামের জন্ম হয়, তখন
যোগমায়ার প্রভাবে তিনি রোহিণীর গর্ভে
স্থানান্তরিত হন। এরপর দেবকীর
অষ্টম গর্ভে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু আবির্ভূত হন শ্রীকৃষ্ণ রূপে।
ভগবান
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম মধ্যরাতে, ঘোর
অন্ধকার, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে
হয়েছিল। কারাগারের দ্বার স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায় এবং
পাহারারত সৈন্যরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন
হয়। বসুদেব নবজাতক কৃষ্ণকে মাথায় নিয়ে যমুনা পার হয়ে গোপালক
নন্দের ঘরে রেখে আসেন
এবং সদ্য ভূমিষ্ঠ যশোদার
কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে ফিরে আসেন। কংস
সেই কন্যাকে হত্যা করতে চাইলে যোগমায়া
আকাশে উঠে দৈববাণী দেন
যে কংসের হত্যাকারী পৃথিবীতেই বড় হচ্ছে। এই
অলৌকিক জন্মলীলা কেবল একটি ঘটনা
নয়, এটি ঈশ্বরের লীলা,
যা ভক্তদের বিশ্বাস ও ভক্তিকে আরও
দৃঢ় করে।
কেন
এই দিনটি হিন্দু ধর্মে এত গুরুত্বপূর্ণ জন্মাষ্টমী হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ:
- ধর্মের
পুনরুদ্ধার: ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধর্মের ধারক ও বাহক। তাঁর জন্ম মর্ত্যে ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে এবং অধর্মের বিনাশ ঘটাতে হয়েছিল।
- ঈশ্বরের
অবতার: শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর পূর্ণাবতার, যিনি মানব রূপে এসে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করেছেন এবং পথভ্রষ্টদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।
- লীলার
মহিমা: তাঁর বাল্যলীলা, কৈশোরের দুষ্টুমি, যৌবনের যুদ্ধ এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনকে দেওয়া জ্ঞান - সবকিছুই ভক্তদের জন্য এক অনন্ত অনুপ্রেরণা।
- প্রেম
ও ভক্তি: শ্রীকৃষ্ণকে প্রেম ও ভক্তির প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। এই দিনে ভক্তরা তাদের সমস্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করেন।
পুরাণ
ও মহাভারতের উল্লেখ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও লীলার
বিস্তারিত বর্ণনা বিভিন্ন প্রধান হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়:
- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
(মহাভারতের
অংশ): যদিও এটি সরাসরি তাঁর জন্ম নিয়ে আলোচনা করে না, তবে এটি শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত জ্ঞান, যা তাঁর দৈবত্বের প্রমাণ দেয়। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনকে দেওয়া তাঁর উপদেশগুলি মানবজাতির জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
- শ্রীমদ্ভগবতম্
(ভাগবত পুরাণ): এটি শ্রীকৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর সমগ্র জীবনের বিশদ বিবরণ প্রদান করে। ভাগবত পুরাণ কৃষ্ণের বাল্যলীলা, বৃন্দাবনের রাসলীলা, মথুরায় কংস বধ এবং দ্বারকায় তাঁর রাজত্ব নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। এটি ভক্তদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থগুলির মধ্যে একটি।
- বিষ্ণু
পুরাণ এবং হরিবংশ পুরাণ: এই পুরাণগুলিতেও শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, তাঁর পরিবারের বিবরণ এবং বিভিন্ন লীলা সম্পর্কে সবিস্তার উল্লেখ রয়েছে।
২.
উদযাপনের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি
জন্মাষ্টমী
উদযাপনের প্রধান আকর্ষণ তার ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি
ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে
নিহিত। এই দিন ভক্তরা
পরম নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন।
উপবাস,
পূজা, মন্ত্রপাঠ জন্মাষ্টমীর মূল রীতির মধ্যে
রয়েছে কঠোর উপবাস পালন।
ভক্তরা পূর্বদিন থেকেই সংযম পালন করেন
এবং জন্মাষ্টমীর দিন সূর্যোদয় থেকে
মধ্যরাত পর্যন্ত উপবাস করেন। উপবাসের সময় অন্ন বা
শস্য গ্রহণ করা হয় না,
তবে অনেকে ফল, দুধ ও
জল গ্রহণ করেন।
মধ্যরাতে
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের শুভক্ষণে বিশেষ পূজা-অর্চনা করা
হয়। এই পূজায় নিম্নলিখিত
বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে:
- স্নান
ও বস্ত্র পরিবর্তন: প্রথমে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহকে শুদ্ধ জল, দুধ, দই, ঘি, মধু ও চিনি দিয়ে পঞ্চামৃত স্নান করানো হয়। এরপর নতুন বস্ত্র ও অলঙ্কার পরানো হয়।
- সাজসজ্জা: বিগ্রহকে ফুল, মালা, চন্দন ও বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্য দিয়ে সজ্জিত করা হয়। ভক্তরা নিজেদের ঘর ও পূজামণ্ডপ সাজান।
- ভোগ
নিবেদন: শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় খাবার, যেমন - মাখন, মিছরি, ক্ষীর, লাড্ডু, ফলমূল, দই-চুরা ইত্যাদি ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।
- আরতি
ও মন্ত্রপাঠ: পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে আরতি করা হয় এবং "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে" এই মহামন্ত্র সহ অন্যান্য কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করা হয়।
- শঙ্খধ্বনি
ও উলুধ্বনি: মধ্যরাতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের মুহূর্তে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি দিয়ে উৎসবের সূচনা করা হয়। অনেক বাড়িতে ছোটদের কৃষ্ণ সাজিয়ে পালনায় দোল খাওয়ানো হয়, যা "পালনা উৎসব" নামে পরিচিত।
দই-চুরা, মাখন চুরি, দহি হাণ্ডি উৎসব শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার অংশ হিসেবে মাখন
চুরি ও দই-চুরা
তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এই কারণে
জন্মাষ্টমীতে বিশেষভাবে মাখন ও মিছরি
নিবেদন করা হয়।
- দহি
হাণ্ডি
(Dahi Handi): মহারাষ্ট্র,
গুজরাট সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দহি হাণ্ডি উৎসব অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি কৃষ্ণের মাখন চুরির দুষ্টুমিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যুবকদের দল পিরামিড তৈরি করে উঁচু স্থানে ঝোলানো দই বা মাখনের পাত্র ভাঙার চেষ্টা করে। এটি এক আনন্দময়, প্রতিযোগিতামূলক উৎসব যা 'গোবিন্দা আলা রে' ধ্বনিতে মুখরিত থাকে।
মন্দিরে
বিশেষ আয়োজন জন্মাষ্টমীতে মন্দিরগুলোতে বিশেষ আয়োজন করা হয়। ইসকন
মন্দিরগুলো এই দিনে ভক্তদের
ভিড়ে ভরে যায়। সারাদিন
ধরে ভজন-কীর্তন, ধর্মীয়
আলোচনা সভা, এবং লীলা
প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ভক্তরা
দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে বিগ্রহ দর্শন করেন এবং প্রসাদ
গ্রহণ করেন। অনেক মন্দিরে মধ্যরাতে
মহা-অভিষেক এবং বিশেষ আরতি
অনুষ্ঠিত হয়, যা দেখার
জন্য দেশ-বিদেশ থেকে
ভক্তরা ছুটে আসেন।
৩.
আধুনিক যুগে জন্মাষ্টমীর উদযাপন
যুগের
সঙ্গে তাল মিলিয়ে জন্মাষ্টমীর
উদযাপনের পদ্ধতিতেও এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রযুক্তির সহায়তায় এই উৎসব এখন
আরও বেশি মানুষের কাছে
পৌঁছে যাচ্ছে।
- ডিজিটাল
লাইভ পূজা ও ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান: বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর পরে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পূজার আয়োজন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিভিন্ন মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তাদের জন্মাষ্টমী পূজা, আরতি এবং ভজন অনুষ্ঠান ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব বা জুমের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করে। এর ফলে যারা মন্দিরে যেতে পারেন না, তারাও ঘরে বসেই পূজার অংশ হতে পারেন। ভার্চুয়াল কীর্তন, ধর্মীয় আলোচনা এবং কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয়।
- সোশ্যাল
মিডিয়ায় শেয়ার করা শুভেচ্ছা বার্তা: সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা বিনিময়ের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারে ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের ছবি, ভিডিও, জিআইএফ এবং কোটেশন শেয়ার করে পরস্পরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। #Janmashtami,
#KrishnaJanmashtami, #HappyJanmashtami এর
মতো হ্যাশট্যাগগুলি এই সময় ট্রেন্ডিংয়ে থাকে।
- শিশুদের
জন্য নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: আধুনিক জন্মাষ্টমীর উদযাপনে শিশুদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়। বিভিন্ন স্কুল, কমিউনিটি হল এবং হাউজিং সোসাইটিতে শিশুদের জন্য শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার সাজসজ্জা প্রতিযোগিতা, কৃষ্ণ লীলার উপর ভিত্তি করে নাটক, নৃত্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে শিশুরা তাদের ধর্ম ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে এবং এটি তাদের মধ্যে মূল্যবোধের জন্ম দেয়।
৪.
শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা ও জীবনের দর্শন
শ্রীকৃষ্ণের
জীবন কেবল লীলা ও
অলৌকিক ঘটনার সমাহার নয়, এটি মানবজীবনের
জন্য এক গভীর দার্শনিক
শিক্ষা। তাঁর বাণী ও
আচরণ আজও আধুনিক জীবনে
প্রাসঙ্গিক।
গীতার
শিক্ষা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সংকলিত হয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়, যা মহাভারতের অংশ।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে দেওয়া তাঁর উপদেশগুলি ধর্ম,
কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি এবং যোগের এক
অবিস্মরণীয় সমন্বয়। গীতার মূল শিক্ষাগুলি হলো:
- কর্মফলহীন
কর্ম: ফলাফলের প্রতি আসক্তি না রেখে নিজের কর্তব্য পালন করা (নিষ্কাম কর্ম)।
- আত্মার
অমরত্ব: আত্মা অমর, কেবল দেহের পরিবর্তন হয়।
- যোগ: কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ - এই তিনটি পথ মোক্ষ লাভের উপায়।
- ধর্ম: সত্য, ন্যায় ও righteous পথে জীবনযাপন করা।
- ঈশ্বরের
প্রতি ভক্তি: পরমেশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা ও বিশ্বাস।
ধর্ম,
কর্ম ও ভক্তির মর্ম শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জীবনের প্রতিটি
কর্মের মাধ্যমে ধর্ম, কর্ম এবং ভক্তির
প্রকৃত অর্থ বুঝিয়েছেন:
- ধর্ম: তিনি ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং সমাজের ভারসাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
- কর্ম: নিরাসক্ত কর্মের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, প্রতিটি কর্মই ঈশ্বরের সেবায় নিবেদিত হতে পারে। তিনি নিজে রাজনীতি, যুদ্ধ এবং লোকশিক্ষার মতো বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন, কিন্তু কোনো ফলাফলের প্রতি আসক্ত ছিলেন না।
- ভক্তি: তাঁর প্রতি গোপীদের বিশুদ্ধ প্রেম এবং অর্জুনের শরণাগতি ভক্তির সর্বোচ্চ উদাহরণ। তিনি বলেছেন, "যে আমাকে যেভাবেই ভজনা করে, আমি তাকে সেভাবেই ফল প্রদান করি।"
আধুনিক
জীবনে শ্রীকৃষ্ণের দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা আধুনিক জীবনেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক:
- মানসিক
শান্তি: ফলাফলের চিন্তা না করে কাজ করলে মানসিক চাপ কমে।
- কর্তব্যপরায়ণতা: নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালনের গুরুত্ব শেখায়।
- নেতৃত্ব: সংকটকালে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করে।
- সম্পর্ক: প্রেম, ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ সেবার মাধ্যমে সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
- অহংকার
ত্যাগ: নিজেকে নিমিত্ত মনে করে কাজ করলে অহংকার কমে।
- আধ্যাত্মিক
বিকাশ: কর্ম ও ভক্তির মাধ্যমে আত্মিক উন্নতির পথ দেখায়।
৫.
বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মাষ্টমীর বৈচিত্র্যময় উদযাপন
জন্মাষ্টমী
ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন
অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন রীতিনীতি ও উৎসাহের সাথে
পালিত হয়, যদিও মূল
ভাব একই থাকে।
মথুরা, বৃন্দাবন, ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি স্থানে বিশেষ আয়োজন
অঞ্চল |
প্রধান
বৈশিষ্ট্য |
মথুরা ও বৃন্দাবন (ভারত) |
শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা এবং লীলাভূমি বৃন্দাবনে জন্মাষ্টমী সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। এখানে "ঝুলন উৎসব" বিশেষ আকর্ষণ। জন্মানোর আগে শ্রীকৃষ্ণকে পালনায় দোলানো হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই সময় মথুরার
দ্বারকাধীশ মন্দির এবং বৃন্দাবনের বাঁকে বিহারী মন্দির, ইসকন মন্দির সহ অন্যান্য মন্দিরে
ভিড় করেন। রাসলীলা মঞ্চস্থ করা হয়, যেখানে কৃষ্ণের বাল্যলীলা ও রাসলীলা প্রদর্শন
করা হয়। গভীর রাতে উৎসবের উন্মাদনা চরমে পৌঁছায়। |
মহারাষ্ট্র
(ভারত) |
মহারাষ্ট্রে দহি হাণ্ডি উৎসব জন্মাষ্টমীর উদযাপনের প্রধান আকর্ষণ। মুম্বাই ও পুনেতে বিভিন্ন
"গোবিন্দা"
দল মানব পিরামিড তৈরি করে উঁচু স্থানে ঝোলানো মাটির হাড়ি ভেঙে দেয়। এটি কৃষ্ণের মাখন চুরির প্রতীকী রূপ। এই উৎসবে প্রচুর
উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং প্রতিযোগিতা দেখা যায়। |
দক্ষিণ ভারত (ভারত) |
তামিলনাড়ু ও কেরালায় শ্রীকৃষ্ণ
জয়ন্তী বা গোপাল অষ্টমী
নামে পালিত হয়। ঘর সাজাতে কোলম
(রঙ্গোলি) আঁকা হয়। মিষ্টি ও নোনতা বিভিন্ন
ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। শিশুরা ছোট কৃষ্ণ সেজে গান গায় ও নাচে। |
বাংলাদেশ (ঢাকা, চট্টগ্রাম) |
বাংলাদেশে জন্মাষ্টমী সরকারি ছুটির দিন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর
ঐতিহ্যবাহী "শোভাযাত্রা" (বর্ণাঢ্য মিছিল) বের হয়, যা হাজার হাজার
ভক্তের সমাগমে মুখরিত থাকে। বিশেষ করে ঢাকার স্বামীবাগ আশ্রম এবং ইসকন মন্দির থেকে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। মন্দিরগুলিতে বিশেষ পূজা, কীর্তন, আলোচনা সভা ও প্রসাদ বিতরণের
আয়োজন করা হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই এই উৎসবে অংশ
নেন। |
পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা (ভারত) |
এই রাজ্যগুলিতেও উপবাস, পূজা এবং ভজন-কীর্তনের মাধ্যমে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। অনেক মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি পূজা করা হয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাড়িতে বাড়িতেও নিষ্ঠার সাথে পূজা করা হয়। |
প্রায়শই
জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
প্রশ্ন
১: জন্মাষ্টমী কেন পালন করা হয়? উত্তর: জন্মাষ্টমী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যে আবির্ভাবের স্মরণে পালিত হয়। এটি ধর্ম
সংস্থাপন, অধর্মের বিনাশ এবং প্রেম ও
ভক্তির বার্তা প্রচারের প্রতীক।
প্রশ্ন
২: জন্মাষ্টমীর উপবাসের তাৎপর্য কী? উত্তর: জন্মাষ্টমীর উপবাস ভক্তদের শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধি
ঘটায়। এটি ভগবানের প্রতি
নিষ্ঠা, ভক্তি ও ত্যাগের প্রতীক
এবং আত্মসংযম শেখায়। মধ্যরাতে কৃষ্ণজন্মের পর উপবাস ভঙ্গ
করা হয়।
প্রশ্ন
৩: দহি হাণ্ডি উৎসব কী এবং এর তাৎপর্য কী? উত্তর: দহি হাণ্ডি হলো
একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যেখানে যুবকদের দল মানব পিরামিড
তৈরি করে উঁচু স্থানে
ঝোলানো দই বা মাখনের
পাত্র ভেঙে দেয়। এটি
শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের মাখন চুরির দুষ্টুমিকে
স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সংঘবদ্ধতা
ও আনন্দের প্রতীক।
প্রশ্ন
৪: শ্রীকৃষ্ণের প্রধান শিক্ষা কী? উত্তর: শ্রীকৃষ্ণের প্রধান শিক্ষা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় সংকলিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে
ফলাফলের প্রতি আসক্তি ছাড়া কর্ম করা (নিষ্কাম
কর্ম), আত্মার অমরত্ব, ধর্ম পালন, এবং
ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত ভক্তি।
প্রশ্ন
৫: জন্মাষ্টমী উদযাপনে আধুনিক প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে? উত্তর: আধুনিক যুগে ডিজিটাল লাইভ
পূজা, ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান, সোশ্যাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছা বার্তা আদান-প্রদান এবং
অনলাইন ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে জন্মাষ্টমী উদযাপন করা হয়, যা
ভক্তদের আরও সহজে উৎসবে
অংশ নিতে সাহায্য করে।
উপসংহার
ভগবান
শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী কেবল একটি প্রাচীন
উৎসব নয়, এটি একটি
জীবন্ত ঐতিহ্য যা যুগে যুগে
ভক্তদের মনে ভক্তি ও
উদ্দীপনা সঞ্চার করে। তাঁর জন্ম
ছিল এক অন্ধকার যুগের
অবসান ঘটিয়ে ধর্ম ও ন্যায়ের
প্রতিষ্ঠাতার আগমন। তাঁর জীবন ও
শিক্ষা মানবজাতিকে প্রেম, জ্ঞান, কর্তব্যপরায়ণতা এবং নিঃস্বার্থ কর্মের
পথ দেখায়। ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি, আধুনিক প্রযুক্তি এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের
সমন্বয়ে জন্মাষ্টমী আজ এক বিশ্বজনীন
উৎসবে পরিণত হয়েছে, যা কোটি কোটি
মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে
রাখে এবং শ্রীকৃষ্ণের শাশ্বত
বাণীকে স্মরণ করিয়ে দেয় – “যদা যদা হি
ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত, অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।” (যখনই পৃথিবীতে ধর্মের
অবক্ষয় হয় এবং অধর্মের
প্রসার ঘটে, তখনই আমি
নিজে আবির্ভূত হই।) জন্মাষ্টমীর এই
পবিত্র দিনে আমরা সকলে
শ্রীকৃষ্ণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এক সুন্দর
ও ধর্মময় সমাজ গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ
হই।